মধু কবির মৃত্যু বার্ষিকী




সাজেদ রহমান
মধু কবির ১৪৬তম মৃত্যু বার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি......
কলকাতায় ঘুমিয়ে আছেন আমাদের মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কাজের কারণে কলকাতা গেলেও যাওয়া হয়নি সেখানে। ২০১৬ সালের জুন মাসে সেই সুযোগ এলো। বাংলাদেশি লেখক যোবায়েন সন্ধি(বর্তমান জার্মান প্রবাসী) তখন কলকাতা। উঠেছিলাম তাঁর টালিগঞ্জের ভাড়া বাসায়। একদিন সকালে তাঁর কাছে মধু কবির সমাধিস্থলে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। যোবায়েন সন্ধি জানালেন, কলকাতা জীবনে তিনিও সেখানে জাননি। গুগল ম্যাপে খোঁজ করলাম। গুগল দেখালো কলকাতার মল্লিক বাজার তাঁর সমাধি। গাড়ি নিয়ে চললাম সেখানে। এরপর ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কবির সমাধিস্থল বেশ যত্নসহকারে রেখেছেন কলকাতার পুর্ত বিভাগ। সমাধিস্থলে যাবার রাস্তাও পাকা। দু’পাশে নানা ফুলের গাছ লাগানো। ছিলাম প্রায় ১ ঘন্টা খানেক। মধু কবির মৃত্যুর দুইদিন আগে ২৬ জুন মারা যান তাঁর স্ত্রী হেনরিয়েটা। তার সমাধি’র পাশেই মধু কবিকে সমাহিত করা হয়।
নিজের ‘এপিটাফ’ বা সমাধি লিপি তিনি নিজেই রচনা করে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর পনেরো বছর পরে তাঁর সমাধিক্ষেত্রে সেই সমাধিলিপি উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পিতৃপুরুষ। আজ ২৯ শে জুন, মধুসূদন দত্তের ১৪৬তম মৃত্যুদিন। তাঁর মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে এবারই প্রথম যশোরে আয়োজন করা হয়েছে অনুষ্ঠানের।
কবির সমাধিস্থলে লেখা আছে...
“দাঁড়াও পথিক-বর
জন্ম যদি তব বঙ্গে ! এ সমাধি ¯’লে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন !
যশোরে সাগরদাঁড়ী কপোতাক্ষ তীরে
জন্মভূমি ; জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ন নামে, জননী জাহ্নবী !”
মাত্র ৪৯ বছরের জীবনের শেষ প্রান্তে, চরম অনাদর, অবহেলা, নিঃসঙ্গতা পেয়েছিলেন বঙ্গজননীর এই শ্রেষ্ঠ সন্তান। উনিশ শতকের নবজাগৃতির গর্ব করা বাঙালির সেই কলঙ্ক দূর হবার নয়। মধুসূদনের জীবনীকার যোগীন্দ্রনাথ বসু তাঁর ‘মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন চরিত’ গ্রন্থে লিখেছিলেন “তাঁহারা যদি, কোনরূপে মধুসূদনের দাতব্য চিকিৎসালয়ে মৃত্যু নিবারণ করিতে সক্ষম হইতেন, তাহা হইলে বঙ্গসমাজ একটি গুরুতর লজ্জা হইতে রক্ষা পাইত। বঙ্গদেশের আধুনিক সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি যে অনাথ ও ভিক্ষুকদিগের সঙ্গে প্রাণত্যাগ করিয়াছেন, পরে কবির স্বর্ণময় প্রতিমূর্তি স্থাপন করিলেও এ কলঙ্ক মোচন হইবে না”।
সম্পন্ন পিতার সন্তান হয়েও আর্থিক অনটন কখনোই মধুসূদনের সঙ্গ ছাড়েনি। ১৮৪৩ সালে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট মধুসূদন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এরপর ওই বছরই ১৩ ফেব্রুয়ারি মিশন রো-তে অবস্থিত ওল্ড মিশন চার্চ নামে এক অ্যাংলিক্যান চার্চে গিয়ে তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁকে দীক্ষিত করেছিলেন পাদ্রী ডিলট্রি। তিনিই তাঁর ‘মাইকেল’ নামকরণ করেন। মধুসূদন পরিচিত হন ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত’ নামে। তাঁর এই ধর্মান্তর সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। রাজনারায়ণ দত্ত তাঁর ‘বিধর্মী’ পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। রাজনারায়ণ দত্ত তাঁকে পরিত্যাগ করলেও, বিশপস কলেজে পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করছিলেন। চার বছর পর তিনি টাকা পাঠানো বন্ধ করেন। বিশপস কলেজে কয়েকজন মাদ্রাজি ছাত্রের সঙ্গে মধুসূদনের বন্ধুত্ব হয়েছিল। বিশপস কলেজে অধ্যয়ন শেষ করে যখন কলকাতায় চাকরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন মধুসূদন। তখন তাঁর সেই মাদ্রাজি বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ্যান্বেষণে মাদ্রাজে (অধুনা চেন্নাই) চলে যান মধুসূদন। মধুসূদন মাদ্রাজেও বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেন নি। স্থানীয় খ্রিষ্টান ও ইংরেজদের সহায়তায় তিনি একটি স্কুলে ইংরেজি শিক্ষকের চাকরি পান। তবে বেতন যা পেতেন, তাতে তাঁর ব্যয়সংকুলান হত না। এই সময় তাই তিনি ইংরেজি পত্রপত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। পঁচিশ বছর বয়সে নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যেই তিনি দ্য ক্যাপটিভ লেডি তাঁর প্রথম কাব্যটির রচনা করেন। কবি ও দক্ষ ইংরেজি লেখক হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
মাদ্রাজে আসার কিছুকাল পরেই মধুসূদন রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক ইংরেজ যুবতীকে বিবাহ করেন। উভয়ের দাম্পত্যজীবন আট বছর স্থায়ী হয়েছিল। রেবেকার গর্ভে মধুসূদনের দুই পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়। মাদ্রাজ জীবনের শেষ পর্বে রেবেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার অল্পকাল পরে মধুসূদন এমিলিয়া আঁরিয়তো সোফিয়া নামে এক ফরাসি তরুণীকে বিবাহ করেন। আঁরিয়াতো মধুসূদনের সারাজীবনের সঙ্গিনী ছিলেন। ১৮৫৬ সালে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন। মধুসূদনের শেষ জীবন চরম দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। তাছাড়া অমিতব্যয়ী স্বভাবের জন্য তিনি ঋণগ্রস্থও হয়ে পড়েন। ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৫ দীর্ঘ আট বছর মাদ্রাজ অবস্থানকালে তাঁর পৈত্রিক বাসভবনটিও বেদখল হয়ে গিয়েছিল। পিতা-মাতার মৃত্যু সংবাদও তাঁকে জানানো হয়নি। ১৮৫৬তে কলকাতা ফিরে এসে সামান্য পুলিশ কোর্টে কেরাণীর চাকুরিগ্রহণ করেন পেটের দায়ে। ১৮৫৮ থেকে ১৮৬২ এই পাঁচ বছরেই মধুসূদনের যাবতীয় সাহিত্যরচনা।
১৮৬২ সালের ৯ জুন পৈত্রিক সম্পত্তি জনৈক ব্যক্তিকে পত্তনি দিয়ে হেনরিয়েটাকে কলকাতায় রেখে অনটনকে সঙ্গী করেই ইংল্যান্ডে রওনা দিলেন মধুসূদন। পত্তনি দেওয়ার শর্ত ছিল যে ওই পত্তনিদার মাসে মাসে হেনরিয়েটাকে সংসার খরচের অর্থদেবেন। কিন্তু মধুসূদন প্রতারিত হন। দু’মাস টাকা দেওয়ার পর ওই ব্যক্তি অর্থ দেওয়া বন্ধ করে দেন। হেনরিয়েটা বাধ্য হয়ে লন্ডনে মধুসূদনের কাছে চলে গেলেন। মধুসূদনের আর্থিক অনটন অসহনীয় হয়ে গেল। ওই সময় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আর্থিক সাহায্য না পেলে হয়তো তাঁকে কারান্তরালে থাকতে হতো। ১৮৬৭তে ব্যারিষ্টারি পাশ করে কলকাতায় ফিরে এলেন ও কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিশ করার অনুমতি পেলেন। কিন্তু সফল হলেন না ওকালতি ব্যবসায়ে। ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্যের স্রষ্টা ওকালতির কূট-কচালিতে পারদর্শি হবেন কি করে ? ব্যারিস্টারি করে অর্থ রোজগারের রাস্তা খুললো না। ওকালতি ছেড়ে দিলেন।
১৮৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে মধুসূদন গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। মধুসূদন তখন হিন্দু সমাজে পরিত্যক্ত, খৃষ্টানরাও আপনজন মনে করতেন না তাঁকে। কারণ তিনি কোন গীর্জায় যেতেন না। ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্য প্রণেতা তখন ইন্টালির কলকাতার বেনেপুকুরে এক অপরিসর গৃহকোণে মলিন শয্যায় চিকিৎসা, পথ্যহীন শায়িত। হেনরিয়েটাও অসুখে চিকিৎসাহীন শয্যাশায়ী। চিকিৎসা দূরের কথা, দুবেলা অন্নের জোগাড়ও অনিশ্চিত। কোন সঞ্চয় নেই, কোন রোজগার নেই। শুভানুধ্যায়ী দু’একজনের সামান্য অর্থ সাহায্যে কতটুকু জীবনযুদ্ধ করা যায়! এইসময় উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় দয়াপরবশ হয়ে মধুসূদনকে স্ত্রী, দুই সন্তানসহ উত্তরপাড়া লাইব্রেরীতে নিয়ে আসেন। গঙ্গাতীরে লাইব্রেরি গৃহে নির্বান্ধব মধুসূদন গুরুতর ব্যাধি আক্রান্ত হয়ে শায়িত। হেনরিয়েটাও গুরুতর পীড়ায় আক্রান্ত, শয্যাশায়ীনি। বাল্যবন্ধু গৌরদাস বসাক একদিন উত্তর পাড়ায় মধুসূদনকে দেখতে এসেছিলেন। গৌরদাস তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন “আমি সেই হৃদয় বিদারক দৃশ্যের কথা কোনদিন ভুলবো না। দেখলাম,  বিছানায় শায়িত মধু রক্তবমি করছেন আর মেঝেতে শুয়ে হেনরিয়েটা রোগ যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। তাঁর সন্তান দুটি খিদের জ্বালায় পচা পান্তাভাত খেয়ে ঘরের এক কোণে শুয়ে আছে। আর তাদের ভুক্তাবশেষ সেই পান্তা ভাতের ওপরে শতশত মাছি পড়েছে। আমি হেনরিয়েটার কাছে গেলাম, তিনি তাঁর স্বামীর দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করে অস্ফুট শব্দে বললেন, আমাকে নয় ওঁকে দেখুন”। গৌরদাসকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন মধুসূদন।
গৌর দাস বাবুরা মধুসূদনকে আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন সেখানে কপর্দকহীন(অর্থাভাবে) অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর শয্যাপার্শ্বে হাসপাতালের নার্স এবং দু’একজন ওয়ার্ডবয় ছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিল না। এর পরের ঘটনা আরো মর্মবিদারি। মধুসূদনের মরদেহকে কপর্দকহীন খ্রীষ্টানের মৃতদেহের মত লোয়ার সার্কুলার রোডের কবরখানায় সমাধিস্থ করা হয় ২৪ ঘন্টা মৃতদেহ ফেলে রাখার পর।
তাঁর মৃত্যুরপর ‘সমাজ দর্পণ’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল এই রকম “...আমরা মাইকেলের অশৌচ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। কারণ এরূপ করিলে তৎক্ষণাৎ জাত্যান্তরও সমাজচ্যুত হইতে হইবে। হা মাইকেল ! তোমার অন্তেষ্টির সময় তোমার আত্মীয়গণ রোদন করিতে পারিল না। তুমি পরের মত বিদেশী ও স্লে”ছগণের হস্তে মস্তক প্রদান করিয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছ ! ... নিকটে যাইতে ইচ্ছা করিলেও যাইতে পারিলাম না ।হিন্দু ধর্মের পারে গমন করিয়া তুমি যেন সমুদ্রপারবর্তী জনের ন্যায় বহু দূরবর্তী হইয়া পড়িলে। যাহা হউক, আমরা তোমার নিমিত্ত গোপনে রোদন করিব। বঙ্গভাষা তোমাকে বহুদিন স্মরণ করিয়া রাখিবেন। ...”
১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলা প্রেসিডেন্সির যশোর জেলার কেশবপুরের সাগরদাঁড়ি গ্রামে মধুসূদন দত্তের জন্ম হয়। তিনি ছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত ও তাঁর প্রথমা পত্নী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান। প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে যশোরের সাগরদাঁড়িতে সপ্তাহব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এবারই যশোরের জেলা প্রশাসন তার ২৯ জুন তাঁর মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠানে আয়োজন করেছে। শনিবার টাউন হল ময়দানে তাঁর স্মরণে আলোচনা সভা ও সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। একই ধরনের অনুষ্ঠান হবে কেশবপুরে সাগরদাঁড়িতে কবির পৈত্রিক ভিটায়।