আজ যশোরবাসীর গৌরবের দিন


সাজেদ রহমার, সাংবাদিক
১৭৮১ খ্রীষ্টাব্দের ৭ জুন। তখনও প্রকৃতি বর্ষা ঋতুকে স্বাগত জানায়নি। আবহাওয়া শুষ্ক, বাতাসে গুমোট ভাব। তাপমাত্রাও অসহনীয়। এই নরকযন্ত্রনা সহ্য করার ক্ষমতা সাদা চামড়ার ইউরোপীয় সাহেবদের থাকার কথা নয়। তবুও এই ধরনের পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করেই টিলম্যান হেঙ্কেল ওই দিন সকালে মুড়লীতে তাঁর অফিসের প্রথম কর্মদিবস শুরু করলেন। কলকাতায় দীর্ঘদিন থাকা হেঙ্কেল মুড়লীতে আসতে উৎসাহী হয়েছিলেন লোভনীয় বেতন এবং অন্যান্য সুবিধার জন্য। পদমর্যাদাও কম নয় একাধারে জজ ও ম্যাজিষ্ট্রেট। তাছাড়া স্বয়ং গবর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেষ্টিংস তাঁকে পছন্দ করে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন পরীক্ষামূলকভাবে একটি নতুন প্রশাসনিক পদ্ধতি চালুর জন্য। এটি হেঙ্কেলের জন্য একটি চ্যালেঞ্জও। আর তিনি নিজের জীবনের শূন্য থেকে অনেক উপরে উঠে এসেছেন চ্যালেঞ্জকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পেরেছেন বলেই। নতুন কর্মস্থলে হেঙ্কেল সহকারী হিসাবে পছন্দ করে নিয়ে এসেছেন রিচার্ড রোককে। রোকও কাজে যোগদান করেছেন একই দিন। যশোরের জেলা জজ ও ম্যাজিষ্ট্রেট হিসাবে টিলম্যান হেঙ্কেলের কাজে যোগদানের মধ্য দিয়ে এভাবে ইতিহাসে একটি নতুন প্রশাসনিক কাঠামোর শুরু। এ কারণে এদেশের জেলা প্রশাসনের ইতিহাসে ১৭৮১ খ্রীষ্টাব্দের ৭ জুন একটি মাইলফলক।
টিলম্যান হেঙ্কেল যশোরের প্রথম জজ ও ম্যাজিষ্ট্রেট হিসাবে তার কার্যালয় স্থাপন করেছিলেন মুড়লীতে। সেটি ছিল অতীত ইতিহাস সমৃদ্ধ। দ্বিতীয় চন্ডগুপ্তের আমলে(খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতক) চীনা পর্যটক ফা-হিয়েন ও মহারাজ হর্ষবর্ধনের শাসনকালে (৬ষ্ঠ শতক) ইউয়ান চোয়েন ভারতবর্ষ সফর করেন। তাঁদের বর্ণনায় প্রমান মেলে মুড়লীতে ছিল বৌদ্ধ মঠ। প্রাচীন সমস্ত মানচিত্রে অবস্থান থাকা মুড়লীকে ঐতিহাসিক ক্যানিংহাম বলেছেন, সমতট রাজ্যের রাজধানী ছিল স্থানটি। পাঠান এবং মুঘল আমলেও মুড়লী বিখ্যাত ছিল দানবীর হাজী মুহসীনের স্মৃতিধন্যও। বির্তক যাই থাক না কেন ভৈরব নদীর তীরে যশোর শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ৫ কিলোমিটার দুরে পৌরসভাভুক্ত মুড়লী সেদিন ছিল জেলা কার্যালয় স্থাপনের উপযুক্ত স্থান। হেঙ্কেল ১৭৮১ খ্রীষ্টাব্দের ৭ জুন মুড়লীতে তাঁর কার্যালয় বসান। ১৭৮৯ তে তিনি বদলী হয়ে গেলে তাঁর সহকারী রিচার্ড রোক যশোরের দ্বিতীয় জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ও জজের দায়িত্ব পান। ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে বদলীর আগে তিনি মুড়লীতে কার্যালয় সরিয়ে আনেন সাহেবগঞ্জ এলাকায় বর্তমান জেলা রেজিষ্ট্রি অফিসের কাছে একটি পুরানো ভবনে। মুড়লীর সেই প্রথম ভবনের মতো সাহেবগঞ্জের ভবনটিও কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। যশোর জেলার জন্য প্রথম কালেক্টরেট ভবন তৈরি হয় ১৮০১ খ্রীষ্টাব্দে। সাহেবগঞ্জ নামটিও এখন আর উচ্চারিত হয়, এর পাশেই ছিল কসবা। এটি এখন পুরাতন কসবা নামে পরিচিত। ৮৫ বছর ওই কালেক্টরেটটি দায়িত্ব পালন করে। এরপর ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে বর্তমান কালেক্টরেট ভবনটি একতলা হিসাবে নির্মিত হয়েছিল তখনকার ২ লাখ ৬৩ হাজার ৬শ’ ৭৯ টাকা ব্যয়ে। বাংলায় দীর্ঘতম এই ভবনটি ছিল সেই সময়ে দর্শনীয় এবং তা ৩৬০ দরজা’র ঘর নাম সাধারন মানুষের কাছে পরিচিত ছিল দীর্ঘকাল। মুলকাঠামো ও সৌষ্ঠব বজায় রেখে ১৯৮২ খ্রীষ্টাব্দে এটিকে দোতলায় পরিণত করা হয়। সেটি এখনও বাংলাদেশের অত্যতম দর্শনীয় ভবন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় যশোরের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে চাকরিতে যোগদান করেন। ১৮৬০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্কিম চন্দ্র যশোরে ছিলেন। তিনি অফিস করতেন যশোরের পুরাতন যে রেজিষ্ট্রি অফিস আছে সেখানে।
যশোরকে কেন নতুন জেলার কেন্দ্রস্থল হিসাবে বেছে নেয়া হয়েছিল ? প্রশ্নটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। আসলে বর্তমান যশোর শহরেকে জেলা কেন্দ্র হিসাবে মনোনীত করার পিছরে ছিল অনেক কারণ এবং এটি কিছুটা মুঘল শাসনের ধারাবারিকতার ফলও বলা যায়। যশোর যে প্রাচীন জনপদ, তার স্বীকৃতি আছে ইতিহাসে। তবে রাজা প্রতাপাদিত্য ১৫৮৪ খ্রীষ্টাব্দে ক্ষমতা গ্রহনের পর যে যশোর রাজ্যের আনুষ্ঠানিক জন্ম দেন, তার কেন্দ্র বিন্দু ছিল বা রাজধানী ছিল বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ‘ধুমঘাট’ নামক স্থানে। প্রতাপের মুঘল বাহিনীর হাতে পরাজয়ের পর ফৌজদাররা (মুঘল) ধুমঘাটে কিছু কাল অবস্থানের পর শাসন কেন্দ্র সরিয়ে আনেন ১৬৪৯ খ্রীষ্টাব্দে বর্তমান যাশোরের কেশবপুরের কপোতাক্ষ ভদ্রা নদীর সঙ্গম স্থলে মীর্জানগরে। বাংলা কোম্পনী শাসনে গেলে সব দিক বিবেচনায় তাঁরা বর্তমান যশোরকে ভবিষ্যত শাসন কেন্দ্র বানতে সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ কলকাতার সঙ্গে সড়ক ও নৌ পথের যোগাযোগ ব্যবস্থ থাকা। গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড কলকাতা হয়ে যশোর ছুঁয়ে চলে গিয়েছিল সোনারগাঁ। যদিও তা ছিল চলাচলের অযোগ্য, তবুও সেই পথে যাতায়াত চালু ছিল। যশোর থেকে ভৈরব হয়ে কপোতাক্ষ-মাখাভাঙ্গা-চুর্নী নদী দিয়ে ভাগীরথী (গঙ্গা) পথে কলকাতা যাওয়া যেত এবং এ নৌপথ তখন ছিল নাব্য। যশোর নামকরণ নিয়ে নানা মতভেদ আছে। এর মধ্যে একটি যুক্তি অনেকের কাছে গুরুত্বপুর্ণ। সেটি হলো চতুর্দশ শতাব্দীতে খান জাহান আলী বাগেরহাট যাবার পথে যশোরে অবস্থান করেন এবং ভৈরব নদীর উপর ঝুলন্ত সেতু বানান রশি দিয়ে। ফারসী শব্দ ‘জসর’ অর্থে সেতু। জেলা কেন্দ্র স্থাপন হওয়ায় যশোরে বিট্রিশরা ছাড়াও প্রচুর ইউরোপীয় আসেন। ১৮৪৬ খ্রীষ্টাব্দে ভোলানাথ চন্দ্র নামের এক পর্যটক কলকাতা থেকে যশোর ভ্রমন করেন এবং লেখেন শহরের স্থায়ী বাসিন্দারা হলেন আমলা, মোক্তার, দোকানদার ও শ্রমিকগন। শহরের মহিলাদের মধ্যে আছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাইপ্রাসের অধিবাসী। এটি অস্বাস্থ্যকর স্থানও। প্রচুর লোক ম্যালেরিয়াতে মারা যান। খ্রীষ্টান সমাধিতে শুয়ে থাকা বিশিষ্ট সরকারী কর্মকর্তাদের নামও তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন।
প্রথম জেলা হিসাবে যশোরের অধীন বর্তমান খুলনা, ফরিদপুর, পাবনা, নদীয়া ও ২৪ পরগনা জেলার অধিকাংশ এলাকা অন্তর্ভুক্ত ছিল। বার বার এর সীমানা বদল হয়েছে। ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে যশোরের মহাকুমা খুলনা পৃথক হয়ে জেলা হয়। দেশ ভাগের সময় বনগাঁ মহাকুমাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ২৪ পরগনার সাথে। সর্বশেষ ১৯৮৪ খ্রীষ্টাব্দে যশোরের ৪ টি মহাকুমাই পরিণত হয় জেলায়। যশোরের বকচরের জমিদার দানবীর কালীপোদ্দার যশোর-চাকদহ(নদীয়া) সড়ক নির্মান করেন। যশোর-বনগাঁ থেকে কলকাতা অংশ, যেটি ছিল গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ধবংসাবশেষ, সেটিও নির্মান ও সংস্কারে সহযোগিতা করেন তিনি। কলকাতায় ‘যশোর রোড’ এখনও এর সাক্ষ্য দেয়। আঠারো শতকে রেল পথ যশোরকে কলকাতার সাথে যুক্ত করে। ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে যশোর থেকে একটি রেল শাখা দর্শনার সাথে যুক্ত হয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যশোরে তৈরি হয় বিমানবন্দর ও বিমান ঘাঁটি। যশোরের সাংস্কৃতিক জীবনও সমৃদ্ধ। ১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দে এখানে স্থাপিত হয় পাবলিক লাইব্রেরি, যা ভারতবর্ষ তথা বাংলার প্রাচীন লাইব্রেরির একটি। যশোর জন্ম দিয়েছে বহুখ্যাতিমান সন্তানকে, যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। প্রজা বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, তেভাগার সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রতিটি ক্ষেত্রেও যশোর পালন করেছে অগ্রণী ভুমিকা। কাকতালীয় হলেও ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর যশোর পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়েছিল এবং এটি প্রথম কোন মুক্ত জেলা শহর। প্রথম স্থাপিত জেলা প্রথম মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করার মর্যাদা পাওয়া দুর্লভই বটে। বাংলাদেশের প্রথম পর্যায়ে গঠিত পৌর সভা গুলোর একটি হলো যশোর, যেটি ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দের ১ আগস্ট স্থাপিত। পদাধিকার বলে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মি: ই ডব্লিউ মালোনী পৌর সভার প্রথম চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। বর্তমান চেয়ারম্যান হলেন জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টু। টিলম্যান হেঙ্কেল দিয়ে যে জেলার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের কার্যকাল শুরু, সেই জেলায় এখন জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন মোহা: আব্দুুল আওয়াল।
১৯৮২ খ্রীষ্টাব্দে যশোরে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনও বসেছিল। যশোর বার বা আইনজীবী সমিতি সুপ্রাচীন। এর জন্ম ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দে। যশোর জিলা স্কুল স্থাপিত হয় ১৮৩৮ খ্রীষ্টাব্দে। এর প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন মি: জে স্মিথ। স্কুলের বহু শিক্ষার্থী তাদের মেধাবলে বহু শীর্ষে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন নিজেদের। যশোর শহর প্রয়োজনীয় উন্নয়নের ছোঁয়া পায়নি এটা সত্য। বিভাগের দাবি উপেক্ষিত থেকেছে। যদিও এটি প্রথম শ্রেণীর পৌর সভা। ৫ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করেন শহরে।
প্রতিটি জেলা শহরের আছে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গর্ব করার মতো উপাদান। যশোরের গর্ব এখানে যে, এটি অবিভক্ত বাংলার প্রথম জেলা কেন্দ্র। এই শহরে টিলম্যান হেঙ্কেল গর্বনর জেলারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের আস্তাভাজন হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে আধুনিক জেলা প্রশাসন জন্মের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন। তার সে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরবর্তীকালে প্রয়োগ হয়েছিল অন্যত্র। সেই জেলা শহর তার আধুনিককালের দু’ শতাব্দীরও বেশি অতিক্রম করেছে। কিন্তু জেলা শহরের খুব মানুষই জানেন সে সব ইতিহাস। অন্ধ অতীতের দরজায় কড়া নাড়লে যাঁদের নাম উচ্চরিত হয়, তারাও বিস্মৃতির আড়ালে। অথচ কত জীবন্তই না ছিলেন তাঁরা তাঁদের আমলে।
 ছবি- আজিম উল হকের তোলা।