মধুসূদনের প্রচন্ড আগ্রহ ছিল ভাষা শেখার প্রতি


মাত্র তিন বছর বিশপস্ কলেজে ছিলেন মধুসূদন, এই তিন বছরে শিখেছিলেন অনেক কিছু। মধুসূদনের প্রচণ্ড আগ্রহ ছিলো ভাষা শেখার প্রতি। গ্রীক, লাতিন আর সংস্কৃত তিনটি প্রাচীন ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিলো এখানেই। বাঙলার চর্চা অবশ্য করেননি মধুসূদন। এই সময়ে তাঁর হাব-ভাব পুরোপুরি সাহেবি। বাঙলার প্রতি একটি তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটে উঠতো, কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে একটি লড়াই চলতো। মধুসূদন যতই সাহেবি ভাব দেখান না কেনো, তিনি যে বাঙালি, তিনি যে ভারতীয় বাঙালি তা ভুলতে পারতেন না কখনও। একবার এক পাদ্রি সাহেবের বাঙলা গান শুনে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন মধুসূদন। আর একবার পোশাক নিয়ে হাতাহাতি হয়ে গেলো কলেজের কর্তৃপক্ষ সাহেবদের সঙ্গে। কলেজে সাহেবদের জন্য ছিলো এক পোশাক, আর বাঙালিদের জন্য ছিলো আলাদা পোশাক। মধুসূদন এই প্রথম বুঝতে পারলেন যে পাদ্রি সাহেবরা শাদা-কালোর পার্থক্য করেন বেশ ভালো ভাবেই। মধুসূদন বললেন, ‘আমাকেও পরতে দিতে হবে শাদা ছাত্রদের পোশাক, নয়তো আমি পরবো দেশি পোশাক। সত্যি সত্যিই পরের দিন মধুসূদন পরে এলেন একটি রেশমি কাবা, তার ওপর একটি কাশ্মীরি শাল, আর মাথায় রঙিন পাগড়ি। একেই বলে শান্ত বিদ্রোহ। মধুসূদনের রকম-সকম দেখে সাহেবরা বুঝলেন এই ছেলেকে না ঘাঁটানোই ভালো। পোশাক নিয়ে শাদা-কালোর পার্থক্য সরিয়ে দিলেন কর্তৃপক্ষ।
হঠাৎ শোনা গেলো বিশপস্ কলেজ ছেড়ে গেছেন মধুসূদন। বন্ধুবান্ধব কেউ জানে না। মধুসূদন ছেলেবেলা থেকেই বেহিসেবি ছিলেন। মদ খাওয়ার অভ্যাস হয়েছে ভালোই। বোধহয় বাবার সঙ্গে টাকা টাকা-পয়সা নিয়ে মন কষাকষি হয়েছে, তাই অভিমানী ছেলে রাগের মাথায় ঠিক করে ফেলেছেন নিজের পায়েই দাঁড়াবেন। তাই গোপনে মধুসূদন কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন, প্রাণের বন্ধু গৌরদাসকেও জানালেন না।

পরে খবর এলো মধুসূদন এখন মাদ্রাজে। তখন কলকাতারই মতো ব্রিটিশদের তৈরি একটি শহর। সেখানে অনেক সাহেবের আড্ডা, অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সংখ্যাও অনেক। মধুসূদন একটি স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে চাকুরি নিলেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই অনেকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলো। তাঁর প্রতিভায় অনেকে আকৃষ্ট হলেন অনেকেই। মধুসূদন এখানে সম্পূর্ণ স্বাধীন। মা-বাবার সামান্য শাসনটুকুও এখানে নেই। আত্মীয়দের তোয়াক্কা কোনোদিনই তিনি করেননি। বন্ধুবান্ধব কেউ নেই কাছাকাছি। সম্পূর্ণ নতুন সমাজ।
মধুসূদন আট বছর ছিলেন মাদ্রাজে। সুখে-দুঃখে কাটানো এই আট বছর মধুসূদনের জীবনে স্মরণীয়। এখানেই মধুসূদনের বিয়ে হয় রেবেকা নামে এক তরুণীর সঙ্গে, তাঁদের সন্তানও হয়। বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর লেখা বের হতে থাকে। ‘অ্যাথেনিয়াম’ নামে একটি পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হয়েছিলেন তিনি কিছুদিনের জন্য। এমনকি ‘হিন্দু ক্রনিকল্’ নামে একটি পত্রিকাও বের করে ফেলেছিলেন নিজেই। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর কবিখ্যাতি ছড়াচ্ছিলো ক্রমশ। ‘ভিজনস্ অব দ্য পাস্ট’ নামে একটি কবিতা লিখলেন তিনি, সেই কবিতার মধ্যে আছে বাংলাদেশের স্মৃতি। তিনি লিখেছিলেন, ‘বাংলা! তোমার উষ্ণআর্দ্র প্রান্তর / তোমার প্রাচীন বটের শান্ত-স্নিগ্ধ ছায়া’। বাংলাদেশকে সম্মোধন করে তখন পর্যন্ত কোনো বাঙালি কবি কবিতা লেখেননি। মধুসূদন যেখানেই থাকুন, তাঁর মনের মধ্যে জেগে আছে বাংলাদেশ।

মাদ্রাজ জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো, ১৮৫৪ সালে ছাপা হলো মাইকেল মধুসূদন দত্তের ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ, ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’। কবিতার বিষয় পৃথ্বীরাজ আর সংযুক্তার কাহিনী। একজন ভারতীয়ের পক্ষে ইংরেজিতে কবিতা লেখাই তখন প্রশংসার ব্যাপার। আর একটি বই লিখে ফেলা তো বিরাট খবর। ‘ক্যাপটিভ লেডি’ সাড়া জাগালো চারিদিকে। ভারতীয়রা গর্বিত, সাহেব-সুবোরাও অবাক! মধুসূদনের বন্ধুবান্ধবেরা খুবই খুশি। মাদ্রাজ থেকে মধুসূদন বই পাঠালেন গৌরদাসকে। বই পেয়ে বেজায় খুশি গৌরদাস, তবে গৌরদাসের ইচ্ছে মধুসূদন বাঙলায় লিখুক। বাঙলায় লেখার কথা উঠলেই মধুসূদন হেসে উড়িয়ে দেয়। এরই মধ্যে মধুসূদন হঠাৎ গৌরদাসকে লিখলেন, ‘একখণ্ড কৃত্তিবাসী রামায়ণ আর কাশীদাসী মহাভারত পাঠিয়ে দাও! বাঙলা যে ভুলতে চললুম’।
সত্যিই তো! সুদূর মাদ্রাজ, চারিদিকে সাহেব-সুবো, ঘরে মেমসাহেব বউ, বাঙলা বলবেন কখন মধুসূদন! মাদ্রাজ যাবার কয়েক বছর পরেই মা মারা গিয়েছিলেন, এই মায়ের কাছেই বাঙলা শেখা; তিনিই শোনাতেন রামায়ণ আর মহাভারতের গল্প। এখন তাই পড়ে নতুন করে শিখবেন মাতৃভাষা।
এক কপি ‘ক্যাপটিভ লেডি’ গৌরদাস পাঠিয়েছিলেন তখনকার বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ইংরেজ বেথুন সাহেবকে; তখনকার বাঙালিরা বেথুন সাহেবকে খুব সম্মান করতেন। তাঁর নামেই পরে হয়েছিলো বেথুন কলেজ। বেথুন সাহেব বই পড়ে একটি চিঠি লিখলেন গৌরদাসকে, ‘লেখা তো ভালোই, মাইকেলের ক্ষমতা আছে, প্রতিভা আছে, তবে তিনি যদি নিজের ভাষায় লেখেন তাহলে উপকার হবে অনেক বেশি; আর তাঁর খ্যাতি হবে চিরস্থায়ী। বাঙলা সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করা, আরও বড় করা—সেইটাই হবে একজন তরুণ কবির যথার্থ কাজ। তাছাড়া মাইকেল ভালো ইংরেজি জানেন, তিনি বাঙলায় অনুবাদ তো করতে পারেন। অনুবাদের মধ্য দিয়ে একটা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়। বেশিরভাগ ইউরোপিয় সাহিত্য গড়ে উঠেছে অনুবাদের মধ্য দিয়ে।’
গৌরদাস বেথুন সাহেবের চিঠি পড়ে খুবই খুশি। চিঠি পাঠিয়ে দিলেন মধুসূদনের কাছে। সঙ্গে একটু খোঁচা দিয়ে লিখলেন, ‘আমি কতোবার বলেছি, সে তো কানে নাওনি। এখন দেখো সাহেব কী বলেছেন। ইংরেজি সাহিত্যে আর একটি বায়রণ আর শেলি চাই না। কিন্তু বাঙলায় যে একজনও নেই।’

#রুদ্রসাইফুল