অমৃতময়ীর নামে ঝিকরগাছার অমৃতবাজার


সাজেদ রহমান।। অমৃতময়ীর নামে যশোরের ঝিকরগাছার অমৃতবাজার।
ব্রিটিশ ভারত সময়ে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির যশোর জেলার ঝিকরগাছার মাগুরার (অধুনা বাংলাদেশ) ধনী ব্যবসায়ী হরি নারায়ণ ঘোষের পুত্র শিশির ঘোষ এবং মতি লাল ঘোষ। হরি নারায়ণ ঘোষের স্ত্রীর নাম ছিল অমৃতময়ী। তাঁর নামেই ওই পরিবার একটি বাজার তৈরি করেছিল। নাম অমৃতবাজার। বাজারের পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কপোতাক্ষ নদ। দুই ভাই ওই গ্রামের নামে প্রকাশ করলেন
অমৃতবাজার পত্রিকা। এটা হল ভারতীয় একটা অন্যতম প্রাচীন বাংলা ভাষার দৈনিক সংবাদপত্র। মূলত বাংলা লিপিতে প্রকাশিত, এটা প্রথম দ্বিভাষিক থেকে ইংরেজি বিন্যাসে বিবর্তিত হয়ে কলকাতা এবং অন্যান্য স্থান যেমন কটক, রাঁচি এবং এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এই সংবাদপত্র প্রথম প্রকাশিত হওয়ার ১২৩ বছর পর ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে এর প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি অমৃতবাজার পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। শিশির ঘোষ এবং মতি লাল ঘোষ প্রথমে একটা সাপ্তাহিক পত্র হিসেবে অমৃতবাজার পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। এই পত্রিকা প্রথম সম্পাদনা করেছিলেন মতিলাল ঘোষ, যাঁর প্রথাগত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ছিলনা। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত বেঙ্গলি পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে উঠে এটা নিজের পাঠককুল তৈরি করেছিল। শিশির ঘোষের অবসর নেওয়ার পর তদ্বীয় পুত্র তুষার কান্তি ঘোষ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এবং ১৯৩১ থেকে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পরবর্তী ষাট বছর সম্পাদনা করে পত্রিকাটি পরিচালনা করেন।
অমৃত বাজার পত্রিকা ছিল কোনো ভারতীয় মালিকানায় পরিচালিত সবচেয়ে পুরোনো ইংরেজি দৈনিক। এটা ভারতীয় সাংবাদিকতার বিবর্তন ও বিকাশে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল এবং ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রস্তুতের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে রুশ কমিউনিস্ট বিপ্লবী ভ্লাদিমির লেনিনএবিপি-কে ভারতের সেরা জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র বলে বর্ণনা করেছিলেন।
১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে যশোর জেলার অমৃত বাজার গ্রামে এক বাংলা সাপ্তাহিক পত্ররূপে অমৃতবাজার পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করেছিল। নীলকর সাহেবরা যে সকল কৃষককে শোষণ করত তাদের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য ঘোষ ভাইয়েরা এই পত্রিকা শুরু করেছিলেন। এর প্রথম সম্পাদক ছিলেন শিশির কুমার ঘোষ। ৩২ টাকা দিয়ে কেনা পেটানো কাঠের মুদ্রণ যন্ত্রের সাহায্যে এই পত্রিকা ছাপা হয়েছিল।
অমৃত বাজারে প্লেগ রোগের প্রকোপ দেখা দেওয়ার কারণে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে অমৃতবাজার পত্রিকা কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। ইংরেজি এবং বাংলা দুই ভাষাতেই সংবাদ ও মতামত প্রকাশ করে এখানে এই পত্রিকা একটা দ্বিভাষিক সাপ্তাহিক হিসেবে চালু হয়। এর সরকার-বিরোধী মতামত এবং জনগণের মধ্যে বিপুল প্রভাবের ফলে সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। ভারতের ভাইসরয় লর্ড লিটন প্রধানত এবিপি-এর বিরুদ্ধেই ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে 'ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট' প্রবর্তন করেছিলেন।
১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে পত্রিকা একটা দৈনিক সংবাদপত্রে পরিণত হয়। ভারতীয় মালিকানার দৈনিক সংবাদপত্রের মধ্যে এটাই প্রথম অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চালু করে। লর্ড ল্যান্সডাউনের শাসনকালে এক পত্রিকা সাংবাদিক ভাইসরয়ের কার্যালয়ের পরিত্যক্ত কাগজের ঝুড়ি থেকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে একটা ছেঁড়া চিঠির অংশগুলো যোগ করেন, যাতে ভাইসরয়ের কাশ্মীর সংযুক্তির পরিকল্পনা ছিল। এবিপি চিঠিটা প্রথম পাতায় প্রকাশ করছিল, যেখানে কাশ্মীরের মহারাজা এটা পড়েছিলেন এবং সত্বর লন্ডনে গিয়ে তাঁর স্বাধীনতার জন্যে তদ্বির করেছিলেন।
শিশির কুমার ঘোষও সীমাবদ্ধ নাগরিক স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রচণ্ডভাবে প্রচারে নেমেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন প্রশাসনে ভারতীয়দের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হোক। তিনি এবং তাঁর ভাই মতিলাল, বাল গঙ্গাধর তিলকের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিলক যখন রাষ্ট্রদ্রোহের কারণে অভিযুক্ত হন, তাঁর পক্ষে দাঁড়ানোর জন্যে তাঁরা কলকাতায় তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। যে বিচারক তিলকের ৬ বছর কারাবাসের সাজা শুনিয়েছিলেন তাঁরা তার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করে সম্পাদকীয়ও প্রকাশ করেছিলেন: 'একজন পরীক্ষিত এবং অতুলনীয় দেশপ্রমী দুঃসাহসিকভাবে প্রকৃত দেশপ্রেমিকতার শিক্ষা দেয়।'
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ চাপিয়ে দেওয়ার সময় ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন-এর সঙ্গে পত্রিকার বিভিন্ন সংঘাত ছিল। যেখানে তাকে 'নবীন এবং সামান্য সারবত্তাহীন, অতীত কসরত ব্যতিরেকে কিন্তু অসীম শক্তি দিয়ে নিয়োজিত' বলা হয়েছিল। এই সব সম্পাদকীয়র কারণে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের প্রেস অ্যাক্ট পাস হয়েছিল এবং এবিপি থেকে ৫,০০০ টাকা দাবি করা হয়েছিল। মতিলাল ঘোষের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল কিন্তু তাঁর বাক্-পটুতা এই যাত্রায় তাঁকে জিতিয়ে দেয়।
এরপর ব্রিটিশ রাষ্ট্রশক্তির প্রতি পেশাদারি আনুগত্য দেখিয়ে পত্রিকা ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনায় নিবন্ধ সাজাতে শুরু করে। যখন সুভাষচন্দ্র বসু এবং অন্যান্য ছাত্র কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, পত্রিকা তাঁদের বিষয়গুলো অধিগ্রহণ করেছিল এবং তাঁদেরকে পুণরায় ভর্তির ব্যাপারে সফল হয়েছিল।
এমনকি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মতিলাল ঘোষের মৃত্যুর পরেও পত্রিকা এর জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা ধরে রেখেছিল। লবণ সত্যাগ্রহ চলাকালীন সময়ে এর থেকে ১০,০০০ টাকার উচ্চ জামানত দাবি করা হয়েছিল। এর সম্পাদক তুষার কান্তি ঘোষের (শিশির ঘোষর পুত্র) কারাদণ্ড হয়েছিল। গান্ধিজির নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্যের উদ্দেশ্যে পত্রিকা এর শেয়ার দান করেছিল এবং ব্রিটিশ শাসকদের হাতে তার মতামত এবং কাজকর্মের জন্যে জবাবদিহিতা করতে হতো।
ভারত বিভাজনের সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাকে পত্রিকা সমর্থন করেছিল। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে 'দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং' সময়কালে পত্রিকা তিন দিন ধরে তার সম্পাদকীয় স্তম্ভ ফাঁকা রেখে দিয়েছিল। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট যখন স্বাধীনতার ভোর হয়, পত্রিকা এক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে: ‘‘এই হল ভোর, যদিও এটা মেঘাচ্ছন্ন। বর্তমানে সূর্যালোক একে ভাঙবে।
১৯৫০-এর পূর্বে প্রকাশিত পাঠ্য উদ্ধার করার প্রয়াসে 'বিপন্ন আর্কাইভ প্রকল্প'-এর অংশ হিসাবে, সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা ২০১০ সালে পুরানো সংবাদপত্রগুলিকে (এবিপি এবং যুগান্তর) নিরাপদে সংরক্ষণ এবং পুণরুদ্ধারের জন্য ডিজিটালকরণের প্রকল্প গ্রহণ করে। পত্রিকাটির সংরক্ষণগুলি নেহেরু স্মৃতি যাদুঘর ও গ্রন্থাগার, দিল্লিতে পাওয়া যায় এবং ২০১১ সালে গ্রন্থাগারটি কর্তৃক পত্রিকাটির এক লক্ষেরও বেশি চিত্র ডিজিটালকরণ করা হয়। ছবিটি-ই হপকিনসন ও কপ প্রেসটি অমৃতবাজার পত্রিকার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। এখন এটি নয়াদিল্লির জাতীয় বিজ্ঞান কেন্দ্রে রয়েছে।